টিকুমনি
মোঃ নোমান সরকার
কেউ যখন কোন বিষয়ে কষ্ট পায় তা টিকুমনি
বুঝতে পারে, এমন ভবে বুঝতে পারে যেন সে তা অনুভব করে। কেন সে এতটা অনুভব করে তা কি
তোমরা জানো? আসলে অন্যের কষ্ট আর দুঃখকে টিকুমনি নিজের দুঃখ কষ্ট বলেই মনে করে
বলেই সে এতটা অনুভব করে।
আরে আমি তো ভুলেই গেছি তোমাদের কাছে টিকুমনির পরিচয়টা দেওয়াই হয়নি। সে
হচ্ছে নীলুর টিয়া পাখি। নীলুর ঘরেই সে থাকে। আর নীলুকে তো তোমরা চিনোই, সে ক্লাস
ওয়ানে উঠছে এই বছর, এই শহরে খুব উঁচু একটা বিল্ডিং সে থাকে। আর টিকুমনি দেখতে ভারী
সুন্দর, গলার ও ঘাড়ে পান্না সবুজ আর কলাপাতা সবুজ রং আর লেজের দিকটায় সামান্য নীল
রং সবার মন কেড়ে নিয়েছে। তারচেয়েও সুন্দর তার তাকিয়ে থাকা। টিকুমনিকে দেখে নীলু খুব বুদ্ধিমাতি বুদ্ধিমা্তি
বলেই মনে হয়। আর টিকুমনির পরিস্কার থাকাটা নীলুর খুবই পছন্দ।
গত মাসে স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে
যাওয়ায় নীলুর মন ভারী খারাপ হয়েছিল। বাবা তখন ওর জন্য টিয়া পখি নিয়ে এসেছিল। নিয়ে
এসেছিল টিয়াপাখিটাকে একটা খাঁচায় করে। কিন্তু খাঁচায় টিয়া পাখি থাকবে, এটি নীলুর
পছন্দ হয়নি। সারাদিনই বসে ছিল খাঁচার পাশে। তার কেবলই মনে হয়েছিল টিয়াপাখির কষ্ট
হচ্ছে, টিয়াপাখির কষ্ট হচ্ছে। নীলু বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল, আচ্ছা তাকে যদি কেউ আটকে রাখে,
তার কি ভাল লাগবে? লাগবে না। লাগবে না। লাগবে
না। তাহলে টিয়া পাখির কেন ভাল লাগবে?
নীলু আয়নার মুখমুখি হয়ে আয়নার নীলুকে প্রশ্ন
করছিল, ‘আচ্ছা বলত তোমাকে খাঁচায় আটকে রাখলে তোমার কি ভাল লাগবে’? বলে একবার ডানে
আরেকবার বামে লুকিয়ে আবার উঁকি দিচ্ছিল আয়নায়। বারবার ফিস ফিস করে একই প্রশ্ন করে
যাচ্ছিল।
কি করা যায়, কি করা যায় তাই নিয়ে সে অনেক
অনেক ভেবেছিল। টিয়াপাখিটাকে অনেক অনেক খাবারও দিয়েছিল। কিন্তু টিয়াপাখি কিছুই খেতে
চাইছিল না। কেন খেতে চাইবে? কেন খেতে চাইবে? আটকে রাখলে খেতে কি
ভালো লাগবে? তাকে একবার পড়ার জন্য মা আটকে
রেখেছিল। বিকাল ফুরিয়ে যাচ্ছিল তবুও মা তার কথা শুনেনি, তাকে মিলির সাথে খেলতে
দেয়নি। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা তার জন্য এত্ত এত্ত মজা এনেছিল, সবই তার প্রিয়। কিন্তু
তার খেতে ইচ্ছে করছিল না, একদম না। আটকে রাখার কষ্ট সেই দিন থেকে নীলু জানে।
বিকাল ফুরিয়ে যাবার আগেই নীলু টিয়াপাখির নাম
দিয়েছিল টিকুমনি। কেন এই নাম সে জানে না। তার মনে
হয়েছিল টিকুমনি বলে ডাকলেই টিয়াপাখিটা খাবে, কথা শুনবে। সেই নামে অনেকবার
ডেকেছিল। সম্ভবত নামটা টিয়াপাখির
পছন্দ হয়েছিল। কারন সেই নাম শুনে কয়েকবার সে ঘুরে নীলুকে দেখেছিল, যদিও কোন খাবার মুখে দেয়নি। টিকুমনির ঘুড়ে
তাকানোটা দেখে নীলুর সেকি আনন্দ। কিন্তু খাচ্ছে
না বলে মন খারাপ করেছিল সে। তাই সে বারবার বলছিল, ‘টিকুমনি তুমি কি দুষ্টদের দলে? খাচ্ছ না যে, কথাই শুনছনা?
নীলু মায়ের মতন করে বলল, ‘যে আদর বুঝে না তার সাথে আড়ি’। কিন্তু টিকুমনি
কিছুইতেই খাবে না। বারবার খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে করতে নীলু আপন মনে বলছিল,’ আটকে
রাখলে কেউ খাবার খেতে পারে? পারে না, পারে না,পারে না’।
সন্ধ্যা
বেলা বাবা এসে পাশে বসে বলেছিল, ‘কিরে তোর মন খারাপ কেনরে? আমি তো তোর একজন বন্ধু
এনে দিয়েছি?’ নীলু গালে হাত দিয়ে উদাস গলায় বলেছিল, ‘বাবা যে কি বল! বন্ধু কখনো
বন্দী থাকে?’ বাবা মাথা চুলকে বলল,’তাই তো’! বাবাও মন খারাপ করে খাঁচায় আটকে থাকা
টিয়া পাখির কাছাকাছি এসে একগালে হাত রেখেছিল নীলুর মতন করে। তাই দেখে বাবা আর টিকুমনির জন্য
নীলুর খুব মন খারাপ হয়েছিল। নীলু বলল, ‘বাবা আমি
টিয়াপাখির একটা নাম দিয়েছি। তুমি কি শুনতে চাও’? বাবা মন খারাপ করে মাথা দুলালো।
নীলু বলল, ‘বাবা, টিয়াপাখির নাম দিয়েছি টিকুমনি’!
‘টিকুমনি, আরে এ তো ভারী সুন্দর নাম’! বাবা
হেসে উঠেছিল। আনন্দে বাবার চোখ চকচকে হয়ে
উঠেছিল। তিনি এসে নীলুর কপালে চুমু দিয়ে মাকে
ডাকছিলেন। বাবার মন ভাল হয়েছে দেখে নীলুর চোখে আনন্দে পানি এসে গেল। বাবা অবাক
হয়ে দেখছিল নীলুর চোখে পানি! বাবা অবাক বিস্মিত হয়ে মাকে ডাকেই যাচ্ছিলেন! সাড়া না
পেয়ে বাবা চঞ্চল হয়ে উঠে মাকে ডাকতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
বাবা
সরে যেতেই নীলু অনেকখন ধরেই টিকুমনিকে দেখছিল। তারপর ভয়ে ভয়ে টিকুমনির খাঁচার দরজা
খুলে দিয়েছিল। খুলে দৌড়ে দূরে সরে গেল। দূরে সরে সে হাঁপাতে লাগল। মনে হল সে অনেক
ভারী একটা কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু টিয়াপাখি খাঁচা থেকে বের হল না। নীলু খুব ধীরে
পিছনে সরে যাচ্ছিল। নীলু খুব আস্তে করে ডাকল,’টিকুমনি,টিকুমনি, বের হও, বের হও, টিকুমনি। তুমি শুধু বাবা আর
মাকে বলনা, কে তোমার গেটটা খুলে দিয়েছে। প্লিজ টিকুমনি, প্লিজ’।
সেই কথায় কাজ হল। টিকুমনি খাঁচা থেকে বের হয়ে এসেছিল। বের হতেই উড়ে জানালার গ্রিলে গিয়ে থামল। জানালার অর্ধেকটার
পর্দা সরানো। বাইরের বাতাসে পর্দা নড়ছে। জানালার বাইরে অন্ধকার। অন্ধকার দেখে তার মনে হল, টিকুমনি
এই রাতের অন্ধকারে বাসা তো খুজে পাবে না।
টিকুমনির
দিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীলুর আরেকটা কথা মনে হয়েছিল, টিকুমনি তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। তাও আবার এই অন্ধকারে!
কোথায় যাবে সে, নীলু খুব দ্রুত ভেবে কোন উত্তর পেল না। সে মন খারাপ করে খাঁচার
কাছে চলে এল। খাঁচাটা ছুঁয়ে দিতে মনে হল, এখানেই টিকুমনি ছিল সেই বিকাল থেকে। ছিল আটক অবস্থায়। আম্মু যে সেদিন খেলতে
দেয়নি মিলির সাথে সে কথা মনে হতেই নীলুর বারবার মনে হল টিকুমনি মুক্ত,মুক্ত,
মুক্ত! খাঁচাটা ছুঁয়ে নীলু নিজের মনেই ফিসফিস
করে বলেছিল,‘টিকুমনির, তোমার অনেক অনেক কষ্ট হয়েছে, না? যাক, টিকুমনি তোমাকে কেউ আর আটকে
রাখতে পারবে না। টিকুমনি মুক্ত!মুক্ত! টিকুমনি মুক্ত’!
নীলু মনটা ভালো হয়ে গেল। যাক, টিকুমনির
সেখানে ইচ্ছে যেখানে খুশি সেখানে চলে যাক। কেউ আর তাকে আটকাতে পারবে না।‘
সে খানিকটা এগিয়ে আনন্দ নিয়ে হাত উঠিয়ে বিদাই
দিতে গেল। কিন্তু টিকুমনি যেন তা বুঝলই না। সে তখনই আবার উড়ে খাঁচার কাছে চলে
এসেছিল। নীলু অবাক বিস্ময়ে টিকুমনিকে দেখতে লাগল। নীলু হেসে ফেলল! আনন্দে তার চোখে
পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছতে গিয়ে দেখল, টিকুমনির চোখেও পানি।
Comments
Post a Comment